উপক্রমণিকা
ইদানীং শুভাকাঙ্ক্ষীরা তোমাকে প্রকৃতির কথা বলে,নদীনালার কথা বলে,সহজ সরল জীবন আর সবুজটবুজের কথা বলে। এগুলো সবই উপক্রমণিকা। আসল কথা হলো, এই শহরে তোমার নিরাপত্তা নিয়ে সবাই ভাবিত। বিশেষ করে সেতার-এ-ইমতিয়াজ প্রত্যাখ্যান করাটা তোমার ঠিক হয়নি। সব্বাই চাচ্ছে তুমি কোন একটা মুক্ত অঞ্চলে চলে যাও। অনেক শিক্ষকই তো গ্যাছে। কিন্তু তোমার কোন ভ্রুক্ষেপ নাই।এই যে ধুলিধূসরিত নগর,তার অঙ্গার আর অম্লজান মাখা জটিল কোলাহল,এ তোমার শিরায় শিরায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গ্যাছে।তোমার ভারী কালো চশমার পুরু অবতলে প্রতিসরিত হয় এই শহরের শত সহস্র কারুকার্যময় রশ্মি। তোমার সৌম্য উজ্জ্বল চোখের অপটিক নার্ভগুলো সেই এলোমেলো, ধূসর এবং রঙিন রশ্মি দিয়ে অদ্ভুত সুন্দর সব কোলাজ রচনা করে। এই বেখেয়ালী কোলাজসমগ্র ছেড়ে তোমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। তুমি যেন প্রাচীন কোন নগর রাষ্ট্রের বাসিন্দা। এই নগরেই তোমার নিয়তি নিহিত।
শেষ পর্যন্ত, সবার চাপাচাপিতে, তুমি যে ফুলার রোডের বাড়ি ছেড়ে সেন্ট্রাল রোডে মা’র বাড়িতে উঠেছ, সে-ই অনেক।তোমাদের সেন্ট্রাল রোডের বাসার মাঝখানে একটা আঙ্গিনা আছে। আঙ্গিনার একপাশে একটা জলের কুয়ো। প্রাকৃতিক কুয়ো না, রাজমিস্ত্রি দিয়ে বানানো। পুরনো দিনের বাসাগুলোতে যেমন থাকে। সেইখান থেকে বালটিতে পানি টেনে একটু আগেই তুমি গোছল সেরেছ। গায়ে গেঞ্জি চাপিয়ে বারান্দায় বসে তুমি একটা বই খুলে পড়ছিলে। শহিউদল্লাহ কায়সারের লেখা। পেশোয়ার থেকে তাসখন্দ্। তুমি আর শহিদুল্লাহ প্রায় সমবয়সী। দুজনেই একই বছর বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছ। অনেকদিন ধরে শহিদুল্লাহ তোমাকে রিভিউ করতে বলছিল। এত কিছু ভেতর আর করা হয়নি। ঠিক এই সময় বাইরে গেইট ধরে ঝাঁকি দেয়ার শব্দ তোমার ভালো ঠ্যাকেনি। রুমা খুলতে চেয়েছিল। তুমি দিলে না। নিজেই গিয়ে দরোজা খুললে।
তুমি ওদেরকে চিনতে পারলে। লাল ফতুয়া পড়া ছেলেটাকে তুমি বেশ ক’বার দেখেছ তোমার ক্লাসে। তুমি যখন পড়াতে, অনেকেই তো নিজ ক্লাস রেখে তোমার ক্লাসে এসে বসত, কিম্বা ভরা গ্যালারীর একদম পেছনে দাঁড়িয়ে থাকত। তোমার বাকপ্রতিভা তো তখনই কিংবদন্তি। সবাই হয়তো তোমার সরাসরি ছাত্র না। তারপরও তুমি তাদের শিক্ষক। এদেরকে তুমি জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করতে চেয়েছ। তুমি বলতে এরা এক একটা প্রদীপ। একবার আলো জেলে দিলেই এর হয়ে উঠবে লাল নীল দীপাবলী। ধীরে ধীরে সেই আলো দেশময় ছড়িয়ে পড়বে।
তোমার মুখে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে এলো। তুমি প্রশ্নভরা চোখে ওদের দিকে তাকালে, মুখে কিছু বললে না। অসামান্য বাকপ্রতিভা থাকার পরও অযথা কথা খরচ করার অভ্যেস তোমার নেই।
‘স্যার, আমাদের সাথে একটু আসতে হবে’
‘কি ব্যাপার?’
‘স্যার,দেশের অবস্থা তো দেখছেন। মিলিটারি আপনার পরামর্শ চায়।’
‘তোমাদের কাছে কি অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট আছে?’
‘ওয়ারেন্টের কথা কেন বলছেন স্যার। মিলিটারী আপনার সাথে কথা বলতে চায়। আপনি তো কোন অন্যায় করেন নাই। ঘাবড়াচ্ছেন কেন?’
তুমি ভাবলে কী আর হবে। ওরা তো তোমারই ছাত্র। হয়তো কিছু প্রশ্ন করবে। এড়িয়ে ঢেড়িয়ে উত্তর দেয়া লাগবে। তুমি বেডরুমে এসে আলমারি খুললে। ফেরদৌসির বাসায় যাবার জন্য একটা পাঞ্জাবী ইস্ত্রী করা ছিল। তুমি সেটা বের করে পড়ে নিলে। তোমার মা খেয়ে যেতে বলেছিল। তুমি বললে এসে খাবে।
তোমার কিন্তু আর আসা হলো না। মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজে তোমার আঙ্গুলগুলো ওরা চাপাতি দিয়ে আলাদা করছিল আর বলছিল, স্যার, লেখেন আরও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখেন। ডিসেম্বরের কুয়াশা ভেজা মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ার সময় তোমার বিশ্বাস হচ্ছিল না এরা তোমারই ছাত্র।
১
আমি পাথর নিয়ে কাজ করি। পাথর নিয়ে কাজ করে করে মনটা কেমন পাথরের মত হয়ে গ্যাছে।
পাথরের পাশাপাশি গন্ডার নিয়ে কাজ করলে আরও ভালো হতো। গায়ের চামড়াটা আরও মোটা হয় যেত। তাহলে আর ভিসি স্যারের কথায় কোন বিকার ঘটত না।
গ্যালো সোমবার ভিসি স্যারের ছোট ছেলেটার জন্মদিন ছিল। ইস্টার্ন প্লাজা থেকে একটি রিমোট কন্ট্রোল হেলিকপ্টার কিনলাম। সাথে দুই হাড়ি দই যোগ করে বৃষ্টিতে ভিজে ভিসি স্যারের বাড়ি গেলাম।
কোথায় তিনি খুশী হবেন, থ্যাঙ্কুট্যাঙ্কু দিবেন, তা না উল্টো বকর বকর আরম্ভ করলেন।
‘বেলাল, তোমারে আর আমি কত টাইনব বলতো। এডুকেশন সেক্রেটারিরে ধইরে কমনওয়েলথ ম্যানেজ করলাম, বিদেশ পাঠাইলাম। পিএইচডিটাও করতে পারলা না। কোন রকমে একটা এমফিল নিয়ে চইলে এলে। তুমি না কুস্তিতে চ্যাম্পিওন ছিলে? এর চেয়ে কুস্তি নিয়ে লেগে থাকাই ভালো ছিল’
‘কুস্তি না স্যার, পাঞ্জা। পর পর দু বছর ইন্টার ডিপার্টমেন্ট পাঞ্জা চ্যাম্পিওন’
‘ওই হইলো’
ভাগ্যিস মন বলে একটা ব্যাপার আছে। মনের রাজ্যে সাদাকালো, ছোটবড়, ছেলেবুড়োয় কোন ভেদ নাই। সবাইকেই তুইতুকারি করা যায়, যেমনতেমন গাল দেয়া যায়।
আমি মনে মনে বললাম,
‘বুড্ডা হারামজাদা, তোর ডিগ্রীটাই বা কি? ইন্ডিয়া থেকে কার না কার চামচামি করা একটা ফালতু রাবিশ পিএইচডি। ভিসি তো হয়েছিস বালের লাল নীল দল করে।’
ভিসি স্যারের যেন কথা ফুরোয় না। এই জোকারের উচ্চারণ শুনলে কে বলবে যে একদা এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যের না জানি কী ছিল!
‘শোন বেলাল, অন্তত আমাগো বিভাগীয় জার্নালে কয়েকটা আর্টিকেল পাবলিশ কইরো। ওরা বলে না, পাবলিশ অর পেরিশ?’
আমি বললাম ‘কারা বলে স্যার? র্যা বের লোকজন?’।
ভিসি বিরক্ত চোখে বল্লেন ‘এইটা একটা প্রচলিত কথা। কয়েকটা পাবলিকেশন থাইকলে প্রমোশন কে ঠেকায়? আমি কিন্তু আগেরবারের মত ব্যাকডোর দিয়ে তোমারে প্রোমোশন করাইতে পারব না’
আমি মুখ কালো করে বসে থাকলাম। একটু পর জন্মদিনের কেক কাটা হলো। সবাই হাতাতলি দিলো। আমিও দিলাম। সবাই হ্যাপী বার্থ ডে গাইলো, আমিও গাইলাম।
কিন্তু আমার মনে তখন দুশ্চিন্তার কালো মেঘ দীর্ঘ ছায়া ফেলেছে, আমার কি আর পদোন্নতি হবেনা?
২
মাঝে শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি। শনিবার হরতাল। রবিবার অবরোধ। সোমবার ভোরবেলা অফিস রুমে এসে দেখি জাহিদুল আমার অপেক্ষায় বসে আছে।
‘কী ব্যাপার জাহিদুল’
‘স্যার, আমি বেশ কতগুলো জার্নাল আর্টিকেল লিখেছি। ভিসি স্যার বললেন নূতন কিছু লিখলে আপনাকে একবার ড্রাফ্ট দেখিয়ে নিতে’।
ভিসি স্যারের প্ল্যানটা আমি বুঝতে পারলাম। জাহিদুল বিনয়ী ছেলে। লেখাগুলো নেড়েচেড়ে দিলে ও এক ধরণের এথিকাল লায়াবিলিটিতে পড়বে। সেই বোধ থেকে হয়তো ভবিষ্যতে আমাকেও সহলেখক হিসেবে নেবে। নাম মাত্র পরিশ্রমে আমার প্রমোশনের পথটা পলিশ করা গ্রানাইটের মত ঝকঝকে আর মসৃণ হবে।
ভিসি সাহেবের বাসায় এই যে আমি কেক বিস্কুট নিয়ে যাই, বাজারটা করে দেই, ছেলের চুল কাটিয়ে আনি,পানির কলের প্যাঁচ কেটে গ্যালে মেইনটেন্যান্স থেকে রাতবিরেতে মিস্ত্রী ডাকি- এসবই এখন কড়ায় গণ্ডায় কাজে দিচ্ছে। কি একটা কাব্যি আছে না, জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা, ধুলোয় তাদের যত হোক অবহেলা?
আমি জাহিদুলকে বললাম,
‘কোন অসুবিধা নাই জাহিদুল। রেখে যাও। তোমার মাস্টার্সের থিসীস যেভাবে দেখেছিলাম সেভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখব’।
জাহিদুল তিনটে জার্নাল আর্টিকেলের ড্রাফ্ট রেখে গ্যালো। লেখাগুলোতে নজর বুলিয়ে আমি এক ধরণের ঈর্ষাই বোধ করলাম। ভুলে যাও আমাগো ডিপার্টমেন্টের ভগোচগো ইনহাউস জার্নালের কথা, যে কোন আন্তর্জাতিক জার্নালই এই লেখাগুলো উইকেটকিপারের মত লুফে নেবে।
আহা, জাহিদুল ছেলেটা কীভাবে সব বাঁধা কাটিয়ে অঙ্কের বানরের মত বাঁশ বেঁয়ে বেঁয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে। বাঁশের মধ্যে আরেকটু বেশী করে তেল আর গ্রিজ মাখিয়ে দেয়া যায় না?
৩
হরিদাস পাল আমদের ডিপার্টমেন্টের নামজাদা প্রফেসর। ভূতাত্ত্বিক গবেষণার পাশাপাশি চিন্তার স্বাধীনতা নিয়ে এখানে সেখানে লেখেনটেখেন। কেন যেন হঠাৎ করেই মৌলবাদী গোষ্ঠীরা ওনার পেছনে উঠেপড়ে লাগল। কখনো মৃত্যুর হুমকি, কখনো হাত পা গুঁড়ো করে দেয়ার হুমকি আবার কখনো অবিবাহিতা মেয়েকে উঠিয়ে নেয়ার হুমকি।
বেচারা শেষমেশ তল্পিতল্পা গুটিয়ে ইন্ডিয়ায় চলে গ্যালেন। মাস ঘুরতে না ঘুরতেই ওনার পোস্টে নিয়োগ পেলেন আবু বকর স্যার। বিশিষ্ট মৌলবাদী। মুনীর চৌধুরীর অন্তর্ধানের পেছনে নাকি এর…। যাকগে তাতে আমার কী, আমি এইসব ঝামেলার মধ্যে নাই। লাভের লাভ এই যে, আবু বকর রাজাকারের সহযোগী অধ্যাপকের পোস্টটি এখন ফাঁকা।
এই পোস্টের জন্য পনেরটা অ্যাপ্লিকেশন জমা পড়েছে। মোট চারজন শর্টলিস্টেড। দুজন ইন্টারনাল আর দুজন এক্সটারনাল। ইন্টারনাল দুজন হলো জাহিদুল আর আমি ।
এক্সটারনালদের নিয়ে চিন্তার কোন কারন নেই। ওই সব লোক দেখানো, আইওয়াশ। যতই হার্ভার্ড কেইম্ব্রীজের ডিগ্রী নিয়ে আসুক, ইউনিভারসিটির পোষা ঘোড়াদের ডিঙ্গিয়ে চাকুরীর ঘাস এরা কখনোই চিবুতে পারবে না।
ডক্টর ইউনুস, ডক্টর জামাল নজরুল ইসলাম কিম্বা ডক্টর জাফর ইকবালের মত মানুষও বিদেশ থেকে ফিরে এখানে চাকুরী পান নাই। সবাইকেই শেষমেশ ওই বর্ডারের কাছাকাছি কোন আদর্শ বিদ্যানিকেতনে কাজ বাগাতে হয়েছে। এদেরকেও হবে।
আমার সব চিন্তা জাহিদুলকে নিয়ে। যেমন সে জনপ্রিয় শিক্ষক তেমন তার গবেষণার ধার। আমারই তো প্রাক্তন ছাত্র। আমি জানি ও কী রকম মেধাবী আর পরিশ্রমী। অফিস শেষে আমি যখন আকণ্ঠ গিলতে যাই, এ হারামজাদা তখন লাইব্রেরীতে গিয়ে এক গাঁদা বইয়ের ভেতর উটপাখীর মত মুখ গুঁজে পড়ে থাকে। আরে বাবা এত হিরোগিরিই যদি দেখাবি তো বাংলা মুভিতে গেলি না কেন? শুধু শুধু আমাদেরকে ছোট করা।
আমি চাই বা না চাই, সহযোগী অধ্যাপকের পোস্টটা জাহিদুলই পাবে।
৪
প্রতি বছর সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রছাত্রীদের জন্য ফিল্ড ট্রিপের আয়োজন করা হয়।
এবারের ভ্রমণ দেশের বাইরে। পাথরের রাজ্য মেঘালয়। মার্বেল, গ্রানাইট, স্লেট,স্যান্ড্ স্টোন, লাইম স্টোন, কোয়ার্টজ, কী নেই এই মেঘালয়ে?
মেঘালয় থেকে প্রতিদিন অজস্র পাথর ডাহুকী নদী হয়ে জাফলং-এর গয়াইন নদীতে ভেসে আসে। সেই ভেসে আসা পাথর ঘিরেই বাংলাদেশে কত বড় একটা পাথর ব্যবসা গড়ে উঠেছে। যত বেশী বাড়িঘর আর এপার্টমেন্ট তৈরি হচ্ছে, ততই পাথরের চাহিদা বাড়ছে। পাথরের উত্তোলনের গতি পাথর প্রবাহকেও ছাড়িয়ে গ্যাছে। শ্রমিকরা এখন পাথরের জন্য নোম্যান্স ল্যান্ডে ঢুকে পড়ে। এ নিয়ে সীমান্ত জুড়ে ঘচোমচো লেগেই আছে।
মেঘালয়ে যাওয়ার আইডিয়াটা জাহিদুলের। তার এই ভ্রমণ পরিকল্পনা কিভাবে কীভাবে যেন চতুর্দিকে চাউর হয়ে গ্যাছে। পাথর-বৈচিত্র্য দেখিয়ে ও নাকি ছাত্রদেরকে ভূতত্ত্বে আসক্ত করে ফেলবে।
হাফ টার্ম এক্সামের পরদিন ওর সাথে করিডোরে দেখা হতেই বললাম ‘কী জাহিদুল, তুমি নাকি দলবল নিয়ে দেশের বাইরে যাচ্ছ?’
‘কী করব স্যার। কুমিরের ছানার মত ছাতকের এক চুনা পাথর আর কতবার দেখানো যায়? তার চেয়ে বর্ডার ক্রস করে সামান্য নর্থে গেলে ক্ষতি কী? মেঘালয়ে কত বিচিত্র পাথর আর জিওলজিকাল ভ্যারাইটি। একবার ঘুরিয়ে আনলে দেখবেন ছাত্রদের উদ্দীপনা কেমন বেড়ে গ্যাছে। এদের ভেতর থেকেই একসময় বেরিয়ে আসবে নতুন প্রজন্মের জেইমস হাটন। দেশের ভূগোলটাই তখন পাল্টে যাবে’
মনে মনে বললাম, বাব্বা, বাকোয়াজি তো ভালোই রপ্ত করেছ। এবার আসল কথাটি বল দেখি সোনার চান পিতলা ঘুঘু, এতে তোমার কী লাভ? কী লাভ তোমার? তুমি কি কোন মেয়ের সাথে লটরপটরের ধান্দা করছ? নাকি বিনি পয়সায় নূতন আর্টিকেলের মাল মশলার সন্ধান? মুখে বললাম,
‘কী বলব জাহিদুল, তোমার কাজ যতই দেখি ততই আশটনিশড হই। ইউ আর ইউনিক। ওয়ান অফ এ কাইন্ড। আমার কী ইচ্ছে করছে জান?’
‘কী ইচ্ছে করছে স্যার’
‘ইচ্ছে করছে তোমাদের দলটির সাথে আমিও ভিড়ে যাই’
জাহিদুল মহা উৎসাহে বললঃ
‘যাবেন স্যার? গেলে কিন্তু আমাদের ভীষণ উপকার হয়?’
আমি থতমত খেয়ে গেলাম। এমন গিট্টূ লাগানো সাবলীল উত্তর আশা করিনি। বললামঃ
‘উপকার? আমাকে দিয়ে?’
‘ভিসি স্যার বলেছেন এই ট্যুরে আরেকজন মেম্বার অফ স্টাফ থাকতে হবে। বাইরে থেকে ফান্ড আসছে তো, হেলথ অ্যান্ড সেইফটি রিকোয়ারমেন্ট। সমস্যা হলো কাউকেই রাজি করাতে পারছি না। সবাই ব্যস্ত। আপনি থাকলে তো স্যার কথাই নেই’
তো রাজি না হয়ে কী আর উপায় আছে? একেই বলে ফেঁসে যাওয়া।
৫
বসন্তের এক পড়ন্ত বিকেলে আমাদের বাস এসে থামলো সোহরা মার্কেটে। যায়গাটা চেরাপুঞ্জির মাঝামাঝি কোথাও হবে। তামাবিল থেকে ঘুরাপথে প্রায় ষাট কিলোমিটার।
একদিকে বাসভর্তি উদ্ভিন্নযৌবনা অষ্টাদশী ছাত্রীদের কলকাকলি, অন্যদিকে নোকালিকাই ঝর্ণার কলকল শব্দ, এর মাঝে কথা নাই বার্তা নাই যখন তখন ঝমঝম বৃষ্টি। আমার মেঘমেদুর মনটা ফুরফুরে হয়ে গ্যালো।
রাতের খাবারের পর আমি আর জাহিদুল মোটেলের পাশের পাথর বিছানো পথ ধরে হাঁটছিলাম।
জাহিদুল বলল, ‘সবাই জানে চেরাপুঞ্জিতে পৃথিবীর সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়’।
আমি বললাম, ‘আমিও তো তাই ভাবছি। জল-বিজ্ঞানী না এসে ভু-বিজ্ঞানী কেন এই চেরাপুঞ্জিতেই এলো?’
জাহিদুল বলল, ‘কারন অনেকেই জানে না এই চেরাপুঞ্জি আর তার আশেপাশে লুকিয়ে আছে প্রায় হাজারটা পাথরের গুহা। এগুলোর বেশীর ভাগই ছোট ছোট সুরঙ্গ দিয়ে একটার সাথে আরেকটা সংযুক্ত। অসংখ্য কেইভ আর টানেলের একটা ল্যাবারিন্থ্ বলতে পারেন। মোস্ট অফ দেম আর আনএক্সপ্লোরড অ্যান্ড আনম্যাপড্। ভাবতে পারেন ভূতাত্ত্বিকদের জন্য কত বড় একটা জ্ঞান ভান্ডার? আর তাছাড়া...’।
জাহিদুলের চোখে মুখে নূতন খেলনা পাওয়া বালকের উত্তেজনা।
আমি বললাম, ‘তা ছাড়া কী?’
ও বলল, ‘এখানে এক যায়গায় অনেক ফসিল পাওয়া গেছে। আমার কাছে পাকা খবর আছে। এখানকার ফসিল নিয়ে এখন পর্যন্ত কেউ কাজ করেনি। একবার চিন্তা করুন, আমি যদি ফসিলগুলোর রেডিওমেট্রিক ডেইটিং করি, নেইচার পত্রিকায় পর্যন্ত ছাপিয়ে ফেলতে পারব’।
আমি মনে মনে বললাম, হুম্, ইশটুডেন্ট ফিশটুডেন্ট সব লোক দেখানো। তুমি চান্দু এসেছ নিজের ধান্দায়। জ্ঞ্যানপাপী কোথাকার।
এর ভেতর ঝড়ের মত কতগুলো দিন কেটে গ্যালো খাসী আর গারো পাহাড়ের গুহায় গুহায়। ছাত্রছাত্রীরা যেমন উদ্দীপ্ত তেমন ক্লান্ত। তাই পরদিন ওদের বিশ্রাম দিবস।
জাহিদুল বলল, ‘চলুন এই সুযোগে আপনাকে এক জায়গায় নিয়ে যাই।‘
আমি বললাম, ‘কোথায়?’
জাহিদুল বলল, ‘একদম কাছেই একটা এক্সক্লুসিভ কেইভ আছে। স্টুডেন্টদের নেয়াটা রিস্কি হয়ে যেত। আশেপাশেই গভীর খাঁদ, তার উপর পথ ঘাট কাদায় বৃষ্টিতে মাখামাখি’।
গুহাটা জইন্তা পাহাড়ে। ট্যাক্সি নিয়ে পৌঁছুতে এক ঘন্টার বেশী লাগলো না। একদিকে লাইমস্টোনের গুহা অন্যদিকে পাথুরে মালভূমির গভীর খাদ। খাদের এক ধার দিয়ে সোঁসোঁ আওয়াজ করে হাজার ঘন মিটার পানি মুহুর্মুহু সহস্র ফুট নীচে আছড়ে পড়ছে।
তিরিশ কিলোমিটার লম্বা অত্যাশ্চর্য এই গুহা। গাছের শেকড়ের মত চারিদিকে এঁকেবেঁকে ছড়িয়ে গ্যাছে সুরঙ্গ। ভেতরে হ্যালোজেন লাইট থাকায় অনেক গভীরেও প্রচুর শ্যাওলা আর গুল্ম জন্মেছে। আমরা প্রায় একঘণ্টা ধরে ঘোরাঘুরি করলাম। আমার চেয়ে জাহিদুলেই যেন ফেরার তাড়া বেশী।
গুহা থেকে বের হবার পর দেখি জাহিদুল খাদের দিকে যাচ্ছে। আমাকে পেছন পেছন আসতে দেখে বলল, ‘স্যার আপনি নীচে নামতে থাকেন, আমি এখুনি আসছি।‘ কথাটা আমার ভালো লাগলো না। কিন্তু কী করা।
৬
আমি ঢাল বেঁয়ে সাবধানে নীচে নামছি। হঠাৎ জাহিদের চিৎকার শুনতে পেলাম। চিৎকারটা খাঁড়ির দিক থেকেই আসছে। জাহিদ ওদিকে গ্যালোই কেন আর কী ঝামেলায় পড়েছে কে জানে।
আমি আস্তে ধী্রে ঢাল বেয়ে আবার উপরে উঠলাম। খাদের একধারে অনেকগুলো পাইন গাছ। তার শেকড়বাকড় খাদের উলম্ব দেয়াল থেকে ছুরির ফলার মত বেরিয়ে বেরিয়ে আছে। জাহিদুল ওগুলোরই কয়েকটা ধরে ঝুলছে। কেমন দুর্বল, অসহায় আর চিমসানো লাগছে জাহিদুলকে।
মাটিতে উবু হয়ে আমার একদা পাঞ্জা লড়া বলিষ্ঠ হাতটা জাহিদুলের দিকে বাড়িয়ে দিলাম। জাহিদুল এক হাত দিয়ে শক্ত করে আমার হাতটি ধরল। ওর অন্য হাতে একটা পাথর। জাহিদুল আমার দিকে পাথরটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘স্যার এতে ফসিল আছে, ফেলবেন না যেন’।
জাহিদকে আমি সাবধানে টেনে তুলছি। ঠিক তখনই মনে পড়ল ওর তিনটা আর্টিকেলের ফাইনাল ড্রাফট আমার অফিসের ড্ররে। সবই হার্ডকপি। ইমেইল-টিমেইল না। ইচ্ছে করলেই লেখাগুলো আমি আমার নামে চালিয়ে দিতে পারি। কেউ কিচ্ছুটি জানতে পারবে না।
নিজেকেই বললাম, ভেবে দ্যাখো বেলাল,দিজ ইজ গোয়িং টু বি আ গেইম চেইঞ্জার। একদিকে জাহিদ নেই, অন্যদিকে তোমার নামে এতগুলো পাবলিকেশন। আর ফসিল ভাঙ্গিয়ে খাওয়ার কথা না হয় বাদই দাও।
একেই কি বলে সোনায় সোহাগা কিম্বা মণিকাঞ্চন যোগ? পদন্নোতির এই পরম সুযোগ হেলায় হারানো হবে রামছাগলের কাজ।
আমার পাঞ্জা লড়া শক্ত হাতটা হঠাৎই কেমন যেন দুর্বল দুর্বল লাগলো। জাহিদুলকে এভাবে ধরে থাকলে আমি নিজেই তো পড়ে যেতে পারি, পারি না?
ধর্মে নাকি আছে আগে নিজের জান বাঁচানো ফরজ।
আমি জাহিদুলের হাতটা ঢিলে দিতে দিতে আলগোছে ছেড়েই দিলাম। জাহিদুল হকচকিয়ে গ্যালো। অন্য হাত দিয়ে খপ করে আমার হাতটা আবার ধরল, রিফ্লেক্স অ্যাকশন।
আমি এবার জোরে একটা ঝাটকা মারলাম।
জাহিদুল এখন অভিকর্ষ বলের অধীন। জাহিদুলের চোখেমুখে আতঙ্ক আর অবিশ্বাস। ওর দৃষ্টি আমার দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণ বর্শার ফলা গেঁথে দিচ্ছে। জাহিদুল নিশ্চয় ভাবছে, উনি তো আমার শিক্ষক এবং সহকর্মী, উনি কি এ কাজ করতে পারেন?
আমি কিন্তু কিছুই ভাবছি না। পাথর নিয়ে কাজ করে করে আমার মনটাও পাথর হয়ে গ্যাছে।